এফ আই রানা লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি: একদিকে উম্মুক্ত পাথর ভাঙা মেশিনের প্রকট শব্দ অন্যদিকে ধুলা আর ধুলায় আচ্ছন্ন পরিবেশ। এতে দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ঘটছে ব্যাঘাত। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে হাজারও মানুষ।
লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর যেন শব্দ দূষণ আর ধুলার নগরী। এসবে অতীষ্ঠ এ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী, পথচারি, শিক্ষার্থী, দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ সর্ব স্তরের মানুষ। ধুলা আর অত্যধিক শব্দে বুড়িমারী ইউনিয়নে বসবাসকারীদের দেখা দিয়েছে নানা রোগের উপসর্গ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ বুড়িমারী শুল্ক স্টেশনের (কাস্টমস্) নির্ধারিত এলাকার বাইরে/অতিক্রম করে বুড়িমারী, ইসলামপুর ও উফারামারা মৌজার আবাসিক কিছু বসতবাড়ি ছাড়া প্রায় সবদিকের এলাকার জমি ভাড়া নিয়ে মাঠ বানিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মাঠ গুলোতে পাথর বোঝাই ট্রাক এনে খালি করার পর পাথর ভাঙার যন্ত্রে বিভিন্ন পরিমাপে পাথর ভাঙা হয়। একই স্থান হতে বিক্রির পর ট্রাকে বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। স্থলবন্দরের কাছাকাছি ও মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়কের পাশের জমির মালিকদেরকে বেশি টাকা দিয়ে এসব জমি নির্দিষ্ট মেয়াদের উল্লেখ ও লিখিত চুক্তি করে নেয় ব্যবসায়ীরা। মেয়াদ পর্যন্ত পাথর আনা, বিকট শব্দে ভাঙা ও বিক্রয়ের প্রতিযোগীতা করে ব্যবসায়ীরা।
একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হলে তাঁরা বলেন, স্থলবন্দর হতে বুড়িমারী-পাটগ্রাম মহাসড়কের ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার ও আঞ্চলিক সড়কের উভয় পাশের ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার জুড়ে শত শত পাথরবাহী ভারতীয় ও ভুটানি ট্রাক অবাধে দ্রুত গতিতে আসা-যাওয়া করে। বসতবাড়ি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকট এসব গাড়ি এনে পাথর ওঠানামা ও ভাঙা হয়। বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকা সংলগ্ন বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, আমানতুল্যা প্রধান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আলীমুদ্দিন ছবুরউদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সফিয়ার রহমান রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বুড়িমারী আলীম মাদ্রাসা, বুড়িমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুড়িয়াটারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উফারমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে রয়েছে মাঠ। বসানো হয়েছে একাধিক পাথর ভাঙার যন্ত্র। এসব স্থানে প্রতিদিন উচ্চ শব্দে ভাঙা হয় পাথর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে অন্তত দুই হাজারের অধিক ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করে। ধুলার কারণে শিক্ষার্থীরা নাক-মুখ ঢেকে বিদ্যালয়ে গমানাগমন করে থাকে। পাথর ভাঙা মেশিনের/যন্ত্রের শব্দে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারেন না। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগসহ বুকে ব্যাথা, সর্দি, এলার্জি, মাথা ধরা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি এসব মেশিনের টানা শব্দে শ্রবণ শক্তির সমস্যা ও অস্বস্তির মধ্যে থাকে অনেকে।
স্থলবন্দরে অবস্থিত বুড়িমারী হাসর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনির ছাত্র আশিকুজ্জামান আপন বলেন, ‘বেশি ধুলা ও শব্দে অনেক সমস্যা হয়। স্কুল আসা-যাওয়ার সময় পোষাকে ধুলা পড়ে, ময়লা হয়। অস্বস্থি লাগে। মাঝেমাঝে সর্দিকাশি হয়, মাথাও ধরে।’
আমানতুল্যা প্রধান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনির ছাত্র সিরাতুন্নবী সিয়াম বলেন, ‘ ধুলোবালির কারনে মুখে মাস্ক পরে চলাচল করলেও ধুলা হতে রেহাই নাই।’
বুড়িমারী ইউনিয়নের গুড়িয়াটারী এলাকার বাসিন্দা আবু সাঈদ (৩৩) জানান, ‘স্থলবন্দর হতে মহাসড়ক ও এলাকার বিভিন্ন সড়ক গুলোতে প্রতিদিন অনেক পাথরের গাড়ি ঢুকে এবং বেড় হয়। পাথর লোড-আনলোড করে, মেশিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর ভাঙে এতে এলাকায় ধুলা আর শব্দ। পরিবার নিয়ে থাকাই যায়না। বাড়ির জিনিসপত্র ধুলায় ঢেকে যায়, অসুখ হয়।’
সারাদেশে বিট পুলিশিং ব্যবস্থায় দূষিত পরিবেশ মোকাবেলায় বিট পুলিশিংয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাটগ্রাম থানা পুলিশের নিয়োজিত এসআই নিরস্র মোঃ রমজান আলীকে বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার দূষিত পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ইতিমধ্যেই পাটগ্রাম থানা পুলিশের পক্ষ থেকে স্থলবন্দরে নিয়োজিত শ্রমিকসহ স্থানীয় শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারসহ দূষিত পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’
পাটগ্রাম আদর্শ কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ সহর উদ্দিন বলেন, ‘মানব সৃষ্ট বায়ু ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এসব পরিবেশ অধিদপ্তরের দেখা উচিত। বায়ু দূষিত হলে সবার জন্যই সমস্যা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করলে শব্দ ও বায়ু দূষণ কম হত।’
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, ‘আমরা দ্রুত পাথর ভাঙা মেশিন যথাযথ নিয়ম মেনে বসানো হয়েছে কি না, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে কি না এ বিষয় গুলো দেখবো। বায়ু ও শব্দ দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।’
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ নির্মলেন্দু রায় জানান, ‘ধুলা-বালিতে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, এ্যাজমা, টিবি ও সিলিকোসিস রোগসহ শিশু হতে সবারই সমস্যা হতে পারে। শব্দ দূষণে মাথা ও কানে সমস্যা হয়। স্বাস্থ্যবিভাগ হতে আমরা স্বাস্থ্য বার্তা দেই। শব্দ ও বায়ু দূষণ বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে।’