বাবলু তন্তবায় দীপু, চুনারুঘাট( হবিগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ ১৯২১ সালের ২০ মে ঘটে যাওয়া সেই রক্তাক্ত ঘটনাকে স্মরণ করেই চা-শ্রমিকরা দিবসটি পালন করেন। আজ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের লস্করপুর ভ্যালী ছাত্র, যুবক এবং চা শ্রমিকদের সেবক সংগঠনের উদ্যোগে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার লস্করপুর চা বাগানে ২০ মে সকালে র্যালি, আলোচনা সভা ও শহীদদের সম্মানে অস্থায়ী ব্যাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রদান করেন।।
লস্করপুর ভ্যালীর সহ সভাপতি উজ্জলা পাইনকারা সভাপতিত্বে এবং বাগান সভাপতি রজনীকান্ত কালিন্দীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব আব্দুল কাদির লস্কর। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চা বাগানের আদিবাসী নেতা স্বপন কুমার সাঁওতাল, মুকেশ কর্মকার অনুপ, উজ্জ্বল কুমার দাশ, সুবল মালাকার, চা শ্রমিকদের সেবক সংগঠনের সভাপতি শান্তা তাঁতী ( শ্রীমঙ্গল) , চা শ্রমিকদের সেবক সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ বিষ্ণু হাজরা (শ্রীমঙ্গল), আমু চা বাগানের স্বপন মুন্ডা, চা শ্রমিক নেত্রী ও নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার, সন্ধা রানী ভৌমিক, চান্দপুর চা বাগানের সভাপতি সাধন সাঁওতাল, লস্করপুর চা বাগানের সাধারণ সম্পাদক আশিষ তন্তবায় বেবুল, সুমন গৌড়, সুমন পাহান, যুবরাজ ঝড়া, বিশ্বনাথ কালিন্দী, চা শ্রমিকদের সেবক সংগঠনের সহ কোষাধ্যক্ষ লিটন মুন্ডা চা শ্রমিকদের সেবক সংগঠনের সদস্য সাংবাদিক বাবলু তন্তবায় দীপু, লস্করপুর ভ্যালী ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সাংবাদিক, ছাত্র, যুবক এবং মুরব্বি সহ আরো ব্যাক্তিবর্গ সহ অনেকেই।
সমাবেশ ও আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, আজ থেকে ১০২ বছর আগে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিগ্রহিত এখনো চা শ্রমিকরা। শত বছর পেরিয়ে এখনও চা শ্রমিকরা দৈনিক সর্বোচ্চ ১২০ টাকা মজুরি নিয়ে দিনযাপন করছেন। ফলে পাঁচ, সাত শ্রমিক সদস্যের পরিবার চালাতে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। সস্তায় শ্রম কিনে অধিক মুনাফা লাভে ব্রিটিশরা ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ১৮৩৪-১৮৩৫ সালে চা শ্রমিকদের এদেশে নিয়ে আসে।
সে সময় তাদের ‘গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেগাÑগাছ নাড়লে টাকা মিলবে’ এইসব প্রলোভন দেখিয়ে চা শ্রমিকদের সংগ্রহ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। যার মধ্যে অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে হাজার হাজার শ্রমিক মারা যান। তাদের মধ্যে ক্ষুধা, রুগ-ভোগ, মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা এমনকি ফিরে যাবার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। চা শ্রমিকরা ১৯২১ সালের ২০ মে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে উদ্যত হন। স্ত্রী-পুত্র, পরিজন নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুরে জাহাজ ঘাটে এসে জড়ো হয়। চাঁদপুর ঘাটে পূর্ব থেকেই সেখানে প্রস্তুত থাকা ব্রিটিশ পুলিশ ও বাগান মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী গুর্খা বাহিনী বিদ্রোহ দমনের পরিকল্পনা করে। শ্রমিকরা যখন জোর করে জাহাজে উঠতে চাইলো, তখন গুর্খা সৈনিকরা নির্বিচারে শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজনদের উপর গুলিবর্ষন ও নির্যাতন শুরু করে।
এসময়ে শত শত শ্রমিক গুলিব্ধি হয়ে মারা যান। আহত হন আরও প্রায় হাজারো শ্রমিক। রক্তে লাল হয় চাঁদপুর ঘাটের মেঘনা নদীর পানি। এই সময়ে কতজন শ্রমিক নিহত হয়েছিল আর কতজন আহত হয়েছিল তার পুরোপুরি কোন হিসেব পাওয়া যায়নি। লোকজন নদীতে শুধু লাশের সারি ভাসতে দেখে।
নেতৃবৃন্দরা আরো বলেন, চা বাগানগুলো টিকিয়ে রাখার সেই ক্লান্তিকর যাত্রা আজো অব্যাহত থাকলেও এখনো চা শ্রমিকদের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশদের মতো শাসন করা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য সকল জনগোষ্টির সার্বিক উন্নয়ন হলেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন হয়নি। চা বাগানের মানুষেরা এখানো, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা গুলো থেকে বঞ্চিত। এসব অবস্থা থেকে চা শিল্প ও শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকার ও মালিক পক্ষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ।
উল্লেখ্য যে, চা শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ সংক্রান্ত বিষয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান মতবিনিময় করেছেন। প্রতিমন্ত্রী চা শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি থেকে জনপ্রতি ১১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেন।
এ অর্থ তিন কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে জানানো হয়। যার মধ্যে প্রথম কিস্তি আগামী ৭ মার্চের আগেই পরিশোধ করতে হবে। বাকি দুই কিস্তি পরিশোধের সময় চা শ্রমিক এবং মালিকপক্ষ আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন।
গত বছর ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে চা শ্রমিকরা বর্ধিত মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধা পেলেও ২০২১ এর জানুয়ারি থেকে আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত সময়ের জন্য বর্ধিত মজুরির বকেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।