শিরোনাম
চট্টগ্রামে শুরু হলো যুব রেড ক্রিসেন্টের দুইদিনব্যাপী “১ম ফুটব্যাটেল টুর্নামেন্ট – ২০২৫” ৯ম তম ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে আজিমুশ্শান পবিত্র ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (দ.) মাহফিল। বিএনপি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিলেটে পাথর লুটে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির নেতা সাহাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভায় উপস্থিত থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ ইয়ূথ ক্যাডেট ফোরাম চট্টগ্রাম জেলার দ্বি-বার্ষিক সন্মেলন-২০২৫ সম্পন্ন নেপাল থেকে বাংলাদেশ ফুটবল দল রওনা দিয়েছে। নিরাপদ পানি সরবরাহের আস্থা ঢাকা ওয়াসা  ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের বিজয় হয়েছে নেপালে ছাএ জনতার বিক্ষোভে নিহত ৮
শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৬ অপরাহ্ন

অযত্নে অবহেলায় বিলুপ্তির পথে আনোয়ারার যোগেশ চন্দ্র রায়ের জমিদারবাড়ি।

রিপোটারের নাম / ১৮৩ বার পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫

 

মো:আমজাদ হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি : চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার সাত কিলোমিটার দূরে নিরিবিলি গ্রাম পরৈকোড়া। চারপাশে খেতখামার আর ছায়া সুনিবিড় গাছগাছালির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি অর্ধবৃত্তাকার খিলানাকৃতির প্রবেশ তোরণ—যার মাথায় জড়িয়ে আছে বট, অশ্বত্থ আর আগাছার ঝোপ। প্রবেশপথটি পেরিয়ে একটু এগোলেই চোখে পড়ে এককালের রাজকীয় জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। এক সময়ের সাতমহলা প্রাসাদ, শানবাঁধানো পুকুরঘাট, মন্দির, বৈঠকখানা—আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে যেভাবে মানুষের কঙ্কাল দেখেই তার আকৃতি বোঝা যায়, ঠিক সেভাবেই এই ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে অনুমান করা যায় অতীতের সেই গৌরবময় দিনগুলো।

 

এই বাড়িতে একসময় প্রতিদিন সুরের মূর্ছনা বাজত, ঢাকঢোল আর বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে মুখর থাকত চত্বর। ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকা কানন দেবীও এসেছিলেন এই রাজবাড়িতে, দলবল নিয়ে পারফর্ম করতে। গ্রামের প্রবীণরা এখনো সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। জমিদার রায় বাহাদুর প্রসন্ন কুমার ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা, শিক্ষানুরাগী এবং প্রজাবৎসল মানুষ। তার পৃষ্ঠপোষকতায় পরৈকোড়ায় সারা বছর চলত নাটক, গানের আসর, যাত্রাপালা। তার উত্তরসূরিরাও সেই ধারা বজায় রাখতেন। প্রসন্ন কুমারের সময়ে পরৈকোড়ার জমিদারি শুধু আনোয়ারা নয়, বিস্তৃত ছিল চট্টগ্রাম শহর পেরিয়ে মহেশখালী পর্যন্ত। তখন যখন পুরো দেশে বিদ্যুতের নামগন্ধ ছিল না, তখন তার বাড়িতে জেনারেটরের আলোয় জ্বলত বৈদ্যুতিক বাতি।

এই ইউনিয়নে একসময় ছিলেন নয় জন জমিদার। তাদের মধ্যে প্রসন্ন কুমার এবং যোগেশ চন্দ্র রায় বাহাদুর ছিলেন অগ্রগণ্য। জমিদার যোগেশ চন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ দেওয়ান বৈদ্যনাথ ১৬শ শতকে এই অঞ্চলে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। তার দিঘি, হাটবাজার, স্থাপনা আজো বিভিন্ন জায়গায় তার নাম বহন করছে—দেওয়ান বাজার, দেওয়ানজী পুকুর পাড়, দেওয়ান হাট তারই উদাহরণ। হরচন্দ্র রায়ের দত্তকপুত্র হিসেবে যোগেশ চন্দ্র রায় মাত্র ২৭ বছর বয়সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং খুব অল্প সময়েই হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষের ভরসার প্রতীক। তিনি নির্মাণ করেন মুরালি খালের উপর সেতু, লালানগর বাজার, পাকা সড়ক, ডাকঘর, হাসপাতালসহ নানা অবকাঠামো। এমনকি এলাকার শিক্ষার প্রসারে তিনি পরৈকোড়া ইংরেজি স্কুলকে নয়নতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন।

অন্যদিকে প্রসন্ন কুমার তার জমিদারির সময় সংস্কৃতি আর সৃজনশীলতায় গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য পরিবেশ। কলকাতা থেকে শিল্পীরা আসতেন তার বাড়িতে, মাসব্যাপী চলত অনুষ্ঠান। চট্টগ্রাম শহর থেকে কালারপুল হয়ে চানখালী পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ করেছিলেন নিজ খরচে। তিনি বুড়া ঠাকুর দীঘির দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে স্কুলের জন্য জমি দান করেন। তার মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা নয়নতারা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা করে গেছেন বহু বছর। এসব জনহিতকর কাজের কারণে তৎকালীন সময়ের পরৈকোড়া ছিল শিক্ষা, যোগাযোগ, সংস্কৃতি ও উন্নয়নে একদম শীর্ষস্থানীয় অঞ্চল।

কিন্তু আজ সেই কীর্তি রয়ে গেছে কেবল স্মৃতিতে। জমিদার বাড়িগুলো পড়ে আছে ভাঙাচোরা অবস্থায়, দুর্বৃত্তদের লুটপাটে হারিয়ে গেছে বহু মূল্যবান নিদর্শন। রাতের আঁধারে চুরি হয়েছে অমূল্য সম্পদ। যোগেশ চন্দ্র রায়ের প্রধান ভিটার ২২ একর জমি ও দুটি দীঘি তার বংশধর ড. গুরুপদ চক্রবর্তী ট্রাস্টের নামে দান করেন। পরে সেখানে প্রতিষ্ঠা হয় একটি কারিগরি কলেজ।

আজ সেই জমিদারবাড়ি আর ইতিহাস রক্ষায় নেই তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ। স্থানীয় সচেতন মহল ও ইতিহাসপ্রেমীরা মনে করেন, সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এই বাড়িগুলো হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র।

জমিদার বাড়ি দেখতে আসা রাকিবুল হাসান ও মনির হোসেন  বলেন, “যদি ভালভাবে সংরক্ষণ করে বসবাস উপযোগী করা হয়, তাহলে প্রচুর মানুষ দেখতে আসবেন, এটি হয়ে উঠবে অতীতকে জানার একটি নিদর্শন।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আকতার বলেন, “আনোয়ারার এই জমিদারবাড়ি সত্যিই গৌরবের প্রতীক। উপজেলায় থাকা এরকম ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

আজ প্রয়োজন শুধু সচেতনতা ও সরকারি সদিচ্ছা। নাহলে এসব ইতিহাস, এসব কীর্তি, এসব গর্ব—সবই মিশে যাবে মাটির নিচে। আর আমরা হারাবো অতীতের সেই আলোর বাতিঘরকে, যাদের হাত ধরেই এক সময় এ জনপদ আলোকিত হয়েছিল।


এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ