এইচটি বাংলা অর্থনীতি ডেস্ক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে আমদানি ও রপ্তানিকারকদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে, যা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত। এনবিআরের কার্যক্রম ইতিমধ্যেই স্থগিত হওয়ায় তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই এই সমস্যা এখনই সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তারা। এতে আয়োজিত বিজিএমইএ, বিটিএমইএ, বিকেএমইএ, বিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় ১৩টি সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, এনবিআরের অন্তর্ভুক্ত দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উক্ত দপ্তরগুলোর কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চালু থাকায় প্রস্তুত/রপ্তানিকারকেরা যথাসময়ে আমদানি করা কাঁচামাল খালাস করতে পারছেন না। ফলে দেশের রপ্তানিতে বর্ধিত লিড টাইম আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া পোর্টে/বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকার কারণে বৃষ্টি/রোদে নষ্ট হচ্ছে। আংশিক কর্মঘণ্টার কারণে এক কর্মদিবসের মধ্যে প্রত্যাশিত ইউপি পেতে ১০-১৫ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। এতে রপ্তানি বিলম্বিত হচ্ছে। সৃষ্ট জটিলতার কারণে কিছু কিছু বায়ার ইতিমধ্যে এয়ার শিপমেন্ট ও রপ্তানি আদেশ বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি পোর্ট ড্যামারেজ নির্ধারিত রেটের চারগুণ হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা ‘কস্ট অব ড্রয়িং বিজনেস’ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি সমর্থন করেন না বলেও জানান ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ কোনোভাবে কাম্য নয়। একই সঙ্গে তারা একটি দক্ষ ও হয়রানিমুক্ত এনবিআর প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্থাটির সংস্কারের পক্ষে জোরালো সমর্থনের কথা তুলে ধরেন।
তারা সমস্যা নিরসনে আর সময় ব্যয় না করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যথা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিডার যৌথভাবে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা অতীব জরুরি বলে মনে করেন। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতি কিংবা কমপ্লিট শাটডাউনের মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ আমদানি ও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, চলমান স্থানীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নানা পরিস্থিতিতে চাপে থাকা ব্যবসায়ীরা নতুন করে এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে আরও সমস্যায় পড়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা উচিত। একইসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলেন, সব অফিসার যে অসৎ তা-ও নয়, তাদেরও ভবিষ্যৎ আছে, সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে সরকারকে।
এই আন্দোলনের কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে-এমন উদ্বেগের কথা জানিয়ে তারা বলেন, এই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কালক্ষেপণ না করে আজকের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি (বিডা) যৌথভাবে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা জরুরি। তাদের ভবিষ্যৎ ন্যায়সঙ্গত সুরক্ষা ও দেশের অর্থনীতি যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; সেই পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। এসময় তারা আন্দোলনকারীদের দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ‘কলম বিরতি’ ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কোনো শর্ত ছাড়া কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য এনবিআর বন্ধ করে দেয়া কোনোভাবে কাম্য নয়। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়নের নেতা নয় যে তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করবে। দেশের অর্থনীতির একটি পাইপলাইন এভাবে বন্ধ থাকতে পারে না। কাস্টমস বন্ধ হলে রফতানি বন্ধ হয়ে যাবে। যার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোই ভেঙে পড়বে। এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আজকে ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের পিঠ ঠেকে গেলে দেশের পিঠ ঠেকে যাবে। তাই সব পক্ষ একসঙ্গে বসে এ জটিলতার সমাধান করুন।
শাটডাউনের কারণে রপ্তানির ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের তথা বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ ছাড়া কোন দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে; এটা আমাদের জানা নেই।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সংস্কার চায়। তবে এনবিআরে অনেক সৎ অফিসার আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটি বলার অধিকার তাদের আছে। সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তারা এতদিন ব্যবসায়ীদের জ্বালিয়েছে (হয়রানি করা)। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে। দেশের ব্যবসা ও দেশের স্বার্থে সমস্যার সমাধান জরুরি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টানা আন্দোলনে সৃষ্ট অচলাবস্থায় পোশাক খাতে প্রতিদিন ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন
তিনি বলেন, ‘পোশাক শিল্প হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত। আমাদের ৪০ বিলিয়ন রফতানি হয় আর আমদানি হয় ২৫ মিলিয়ন। এখানে ৬৫ বিলিয়ন আমদানি-রফতানি হয়। আমরা যদি ৩০০ দিন কর্মদিবস ধরি, তাহলে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আর্থিক লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে। এটা ক্ষতি বলা যাবে না তবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে ব্যক্তিগতভাবে যে ফ্যাক্টরির শ্রম ধারণ করার সক্ষমতা কম সে ফ্যাক্টরি দেউলিয়া হয়ে যাবে। যার ফলে ওই ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা বেতন পাবে না ও একটি অস্থিরতা তৈরি হবে।’
সাংবাদিক সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন, আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন, বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ, এমসিসিআইর সহসভাপতি সিমিন রহমান প্রমুখ।