ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে একদল দক্ষ প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, যাতে মানুষের দোরগোড়ায় নিরাপদ পানি পৌঁছে দেয়া যায়।
ঢাকা ওয়াসার যাত্রা শুরু ১৯৬৩ সালে, মূলত ঢাকা শহরে পানির জোগান এবং পয়ঃনিষ্কাশনের উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই এ সংস্থার সৃষ্টি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয় ও সরকারের নির্দেশনায় জনস্বার্থে কাজ শুরু করে।
ওয়াসার প্রধান লক্ষ্য হলো বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং পয়ঃনিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা চালু করা।
ঢাকা ওয়াসার অন্যতম প্রধান পানির উৎস হলো গভীর নলকূপ। বর্তমানে শতাধিক ডিপ টিউবওয়েল থেকে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয় এবং আধুনিক পরিশোধনাগারে তা শুদ্ধ করা হয়। এরপর পাইপলাইনের মাধ্যমে ঢাকা শহরসহ আশপাশের এলাকায় বিতরণ করা হয়। ওয়াসার প্রকৌশলীরা নিয়মিত পানি পরীক্ষা করে দেখেন, যাতে গ্রাহকের কাছে মানসম্মত ও নিরাপদ পানি পৌঁছে দেয়া যায়।
ওয়াসার এক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, আমাদের প্রতিদিনের লক্ষ্য হলো মানুষকে নিরাপদ পানি দেয়া। একটি ফোঁটা পানিও যেন দূষিত না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি।’ যেখানে পাইপলাইনের পানি সরবরাহে কোনো কারণে সমস্যা দেখা দেয় বা হঠাৎ সংকট তৈরি হয়, সেখানে ওয়াসার নিজস্ব পানিবাহী গাড়ি দ্রুত পৌঁছে যায়। রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প এলাকায় এসব গাড়ি সময়মতো পানি সরবরাহ করে। এর ফলে সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও নাগরিকরা পানির জন্য অতিরিক্ত ভোগান্তির শিকার হন না।
ঢাকা ওয়াসার সাফল্যের পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হলেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ওয়াসার উন্নয়নে একের পর এক আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। তার নেতৃত্বে নতুন ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। পুরনো পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যাতে লিকেজ কমে। অনলাইন বিল পরিশোধ, গ্রাহক সেবা হটলাইনসহ ডিজিটাল সেবা চালু করা হয়েছে। পানি অপচয় ও চুরি রোধে আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
এমডি বলেন, ওয়াসার কাজ শুধু পানি দেয়া নয়, আমরা স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানুষের জীবনের মানোন্নয়নের দায়িত্বও পালন করি।
ওয়াসার সফলতা নির্ভর করে মূলত মাঠপর্যায়ের ইঞ্জিনিয়ার, কর্মচারী ও শ্রমিকদের ওপর। তারা দিনরাত নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলেন, হোক সেটা গরমের তীব্র দুপুর বা রাতের গভীরতা। যেকোনো পাইপলাইন ভেঙে গেলে, ড্রেনেজ সমস্যার কারণে জলাবদ্ধতা হলে তারা তাৎক্ষণিক মেরামত কাজে নেমে পড়েন। তাদের এই পরিশ্রমের কারণেই রাজধানী প্রতিদিন পরিশুদ্ধ পানি পায়।
ঢাকার সাধারণ মানুষ ওয়াসার কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘ওয়াসার পানির ওপরই আমাদের ভরসা। সংকটের সময়েও ওয়াসার পানিবাহী গাড়ি এসে সহায়তা করে। এটি সত্যিই বড় স্বস্তির বিষয়।’ তবে কিছু গ্রাহক মাঝেমধ্যে পানির স্বচ্ছতা ও গন্ধ নিয়ে অভিযোগ করে থাকেন। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পানি পরীক্ষা এবং সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।
ঢাকার দৈনিক পানির চাহিদা শীতকালে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি লিটার, গরমে তা বেড়ে ২৯৫ কোটি লিটার হয়; বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৯৫ কোটি লিটার, যদিও দৈনিক সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিস্থিতিতে সাধারণত ২৮০ কোটি লিটারই হয়। অন্য সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াসার ক্ষমতা ২৯৫ কোটি লিটার, প্রতিদিন চাহিদা ২৯০-২৯৫ কোটি লিটার এবং দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল সচ্ছল হলেও লোডশেডিংয়ের কারণে সমস্যা হয়।
ঢাকার বর্তমান নন-রেভিনিউ ওয়াটার (এনআরডব্লিই) বা অপচয় ১৮% থেকে ২০% পর্যন্ত পৌঁছায়, যা পাইপ লিক বা অবৈধ সংযোগের কারণে ঘটে। ডিএমএ (ডিস্ট্রিক মিটার এরিয়া) কার্যক্রম গ্রহণের ফলে কিছু অঞ্চলে (এনআরডব্লিউ) ৫-৭% এর নিচে নেমেছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এখনো ৪০% এর বেশি রয়েছে। সিস্টেমের অনুপস্থিতিতে, ওয়াসার আয় হিসেব অনুযায়ী ৯৮% বিলিং করলেও বাস্তব আয় হলো মাত্র ৯৫%, বাকি লস আয় হয় না।
এখনো মূলত ভূগর্ভস্থ জল সংগ্রহই প্রধান : প্রায় ৬৪-৬৫% পানি ভূগর্ভস্থ, বাকি ৩০-৩৬% পৃষ্ঠ পানি উৎস থেকে আসে। ভূগর্ভস্থ স্তর প্রতিবছরে কমছে ২-৩ মিটার হারে, যা উদ্বেগজনক। সারফেস ওয়াটার প্ল্যান্ট প্রকল্পে বাজেট বেড়ে ১০৯.৭৩ বিলিয়ন টাকা হয়েছে এবং সময়সীমা ২০২৭ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ফেজ-৩ প্রকল্পে গত দশকে শুধু ২% অগ্রগতি এবং বাজেট ৮৫ বিলিয়ন টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে; এটি ২০২৯ সাল পর্যন্ত সম্পন্নের পরিকল্পনা রয়েছে। গাঁধারপুর প্রকল্প এমডি পরিদর্শন করেছেন, যা সম্পন্ন হলে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন লিটার পানি রাজধানীতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আগামী ৭ বছরে ভূগর্ভস্থ নির্ভরতা ৬৪% থেকে কমিয়ে ৩০% করার লক্ষ্যে তিনটি নতুন পানি প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে (পদ্মা ও যমুনা থেকে পানি সংগ্রহ)।
তবে ঢাকা ওয়াসার সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজধানীতে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, ফলে পানির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। পাইপলাইনের কিছু অংশ পুরোনো, যার কারণে পানি লিকেজ হয়। এ সমস্যাগুলোর সমাধানে ওয়াসা ইতোমধ্যেই বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের মাধ্যমে নদীর পানি ব্যবহার শুরু করেছে, যাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমে। ভবিষ্যতে আরও তিনটি আধুনিক পানি শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। পুরনো পাইপলাইন ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
সংকট মোকাবিলায় ওয়াসা ৪৮টি পানিবাহী গাড়ি ব্যবহার করে ও জেনারেটর থেকে সহায়তা দেয়, যাতে পানির সরবরাহ বজায় থাকে। ঢাকা ওয়াসা ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানীতে শতভাগ নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্য স্থির করেছে। তারা ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়ির পানির চাপ ও গুণমান পর্যবেক্ষণ করবে। একইসঙ্গে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং ব্যবস্থা চালু করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসা শুধু একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং নাগরিক জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি ওয়াসা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সম্মুখযোদ্ধার মতো কাজ করে যাচ্ছে। এমডি থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের শ্রমিক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই রাজধানীর কোটি মানুষের কাছে প্রতিদিন পরিশুদ্ধ পানি পৌঁছে যাচ্ছে।
সরকার ও ওয়াসার পরিকল্পনা যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ আরও টেকসই হবে এবং মানুষ পাবে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর পানি- যা একটি সুস্থ, সবল জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।












