এইচটি বাংলা আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বশেষ হামলায় অন্তত ১১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসা সূত্র। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩৪ জন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর খাদ্য সহায়তা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষারত সাধারণ মানুষ, যারা রাফাহ শহরের দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য সংগ্রহে গিয়েছিলেন। খবর আল জাজিরার।
শনিবার (১২ জুলাই) কাতারে যুদ্ধবিরতির আলোচনা যখন অচলাবস্থায় পৌঁছেছে তখনই এই গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এতে করে সমগ্র গাজার জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা নিয়ে ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
রাফাহ শহরের আল-শাকুশ এলাকায় জিএইচএফ সাইটের সামনে উপস্থিত থাকা সামির শাত নামে একজন বলেন, “মানুষের রক্তে ভেসে গেছে চারপাশ। যেই ব্যাগে খাবার নেওয়ার কথা ছিল, সেটাই হয়ে গেলো তাদের কাফনের কাপড়।”
মোহাম্মদ বারবাখ নামে এক ফিলিস্তিনি বাবা জানান, ওই ফিলিস্তিনিরা স্নাইপারের গুলিতে নিহত হন। তিনি বলেন, “আমাদের বলা হয়েছিল আসো, খাবার নাও। তারপর হঠাৎ করেই গুলি—আমাদের হাঁসের মতো শিকার করা হয়েছে।”
আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজ্জম বলেন, “জিএইচএফ-এর রাফাহে একটিমাত্র সাইট চালু আছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ সেখানে খাবারের আশায় ভিড় জমাচ্ছেন। এই জনতার ওপর ইসরায়েলি সেনারা সরাসরি গুলি চালিয়েছে, কোনো সতর্কতা ছাড়াই।”
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মে মাসের শেষ দিক থেকে জিএইচএফ সাইটে অন্তত ৮০০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫ হাজার জন আহত হয়েছেন। আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র খালিল আল-দেগরান বলেন, “বেশিরভাগ গুলিই মাথা ও পায়ে লাগে।”
শনিবার গাজা সিটির তুফাহ এলাকার জাফা স্ট্রিটে একটি বাসভবনে হামলায় চার শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়। এছাড়াও, জাবালিয়া ও শাতি শরণার্থী শিবিরে আলাদা আলাদা হামলায় আরও ২২ জন নিহত হয়।
উত্তর গাজার বেইত হানুনে ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৫০টি বোমা ফেলে। গত ৪৮ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ২৫০ বারেরও বেশি হামলা চালিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গাজা সরকারের মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, অপুষ্টিতে অন্তত ৬৭টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং পাঁচ বছরের নিচে ৬.৫ লাখ শিশু চরম পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “গত তিন দিনে আমরা খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতিতে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর।”
এদিকে, কাতারে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনা শনিবার অচলাবস্থায় পড়ে যায়। হামাসের সূত্র জানায়, ইসরায়েলের প্রস্তাবিত মানচিত্র অনুযায়ী প্রায় ৪০ শতাংশ গাজা—বিশেষ করে রাফাহসহ উত্তর ও পূর্বাঞ্চল—ইসরায়েলি দখলে থেকে যাবে, যা হামাস গ্রহণ করছে না।
ইসরায়েলও পূর্বের মার্চ মাসের আগের সীমানায় ফিরে যেতে অস্বীকার করছে। মানবিক ত্রাণের প্রবেশ, যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তি নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ রয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ওমর রাহমান বলেন, “ইসরায়েলের লক্ষ্য এখন কেবল বন্দিদের মুক্তি নয়, বরং গাজার জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুত করা।”
তার মতে, জিএইচএফ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজের কথিত “মানবিক শহর” প্রকল্প আসলে জনগণকে কেন্দ্রীভূত করে একটি বন্দিশিবিরে পরিণত করার কৌশল মাত্র। তিনি বলেন, “এই কথিত ‘মানবিক শহর’ আসলে একটি ঘনবসতিপূর্ণ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।”
ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে সীমাবদ্ধ এলাকায় বন্দি করার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালের এই দিনেই (১৩ জুলাই) লোড শহর থেকে ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাসবিদ লোরেঞ্জো কামেল বলেন, “তাদের অনেকেই পরে গাজা উপত্যকায় আশ্রয় নেন। আজকের এই পরিকল্পনা সেই ঘটনারই আধুনিক সংস্করণ।”